ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন পদ্ধতি
ব্ল্যাক বেঙ্গল বলতে বাংলায় কালো ছাগল বুঝলেও এরা ধূসর'মেটে, বাদামি, হালকা
লালচে বা সাদা কালো মিশ্রিত বর্ণের হয়ে থাকে আর এ ছাগলকে আমরা ব্ল্যাক
বেঙ্গল ছাগল বলে থাকি। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত লাভজনক
ও জনপ্রিয় একটি খামার প্রকল্প।এই ছাগল পালনের অধিক লাভ হওয়ার গ্রামের
প্রত্যেকটি বাড়িতে ব্লাক বেঙ্গল ছাগল পালন করে থাকে। এই জাতের ছাগল ছোট
আকৃতির হলেও দুধ, মাংস এবং চামড়ার জন্য খুব বিখ্যাত। সঠিকভাবে পালন করলে
স্বল্প মূলধনে এটি একটি আই উপার্জনের উৎস হতে পারে। বাংলাদেশের প্রায় ২০
মিলিয়ন ছাগলের মধ্যে ৯৩% পালন করা হয় গ্রামের বাড়িতে বা ছোট বা মাঝারি
খামারে। এর মাংস খুব সুস্বাদু ও বিশ্বমানের হওয়ায় এর চাহিদা
ব্যাপক।
পেজ সূচিপত্র: ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বৈশিষ্ট্য বা চেনার উপায়।
- ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বৈশিষ্ট্য বা চেনার উপায় ।
- ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনের সুবিধা ।
- ছাগল কেনার সময় যেসব দিক লক্ষ্য রাখতে হবে।
- ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের দাম।
- ছাগলের দাঁত দেখে বয়স নির্ণয়।
- ছাগলকে পাল দেওয়ার নিয়ম ও সময়।
- ছাগলের বাচ্চা কে খাসি করন।
- ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বাসস্থান।
- ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের খাদ্য খাবার।
- ছাগলের রোগ ও তার প্রতিকার।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বৈশিষ্ট্য বা চেনার উপায়
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ও দেশী জাতের ছাগল। এদের সহজে
চেনা যায় কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে। যেমন-গায়ের রং প্রধানত কালো, তবে
মাঝে মাঝে সাদা, বাদামি বা ছোপ যুক্ত রঙ্গেও দেখা যায়। দেহের গঠন আকারে ছোট, দেহ
কমপ্যাক্ট মাংসল। তাছাড়া ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বছরে দুই বার বাচ্চা দেয়।
প্রতিবারের দুই থেকে চারটি করে বাচ্চা জন্ম দেয়।
এছাড়াও এর মাংস খুব সুস্বাদু, কম চর্বি যুক্ত এবং বাজারে উচ্চ চাহিদা
সম্পন্ন,শিং ছোট বাঁকানো ধরনের। কান তুলনামূলকভাবে ছোট ও খাড়া। ওজন পূর্ণবয়স্ক
পুরুষ ছাগলের ওজন 20 থেকে 25 কেজি এবং স্ত্রী ছাগলের ওজন ১৫ থেকে ২০ কেজি পর্যন্ত
হয়। বাংলাদেশের আবহাওয়া খুব সহজে মানিয়ে নিতে পারে। অল্প খাবারে বেঁচে থাকে,
এছাড়াও এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক ভালো। এরা স্বভাবে চঞ্চল হলেও
নিয়ন্ত্রণ যোগ্য। এরা দ্রুত বংশবিস্তার করে, তাই ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন
অত্যন্ত লাভজনক।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনের সুবিধা
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনের অনেক সুবিধা আছে, তাই বাংলাদেশে এটি সবচেয়ে জনপ্রিয়
ছাগল জাত। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মাংস উচ্চ চাহিদা। যেমন-মাংস সুস্বাদু, নরম ও
হজমে সহজ হয়। বাজারে দামের দিক থেকেও সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে। ব্ল্যাক বেঙ্গল
ছাগল ছোট আকারের হওয়ায় খাবার চাহিদা কম, অল্প জায়গায় বেশি ছাগল পালন করা
যায়। বাংলাদেশের আবহাওয়ার সাথে সহজেই মানিয়ে নেয়, এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
তুলনামূলক বেশি।
তাছাড়াও এই ছাগলের প্রজনন ক্ষমতা অনেক বেশি বছরে দুইবার বাচ্চা দেয়। একসাথে দুই
থেকে তিনটি, এমন কি কখনো কখনো চার থেকে পাঁচটি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়। এছাড়াও খুব
অল্প পুঁজিতে ছাগল পালন করা যায়, যা গ্রামের দরিদ্র মানুষের জন্য আয়ের ভালো
উৎস। এছাড়া ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল খুব অল্প পুঁজি নিয়ে খামার শুরু করা যায়।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন কম খরচে বেশি লাভজনক ব্যবসা, বিশেষ কোনো গ্রামের কৃষক,
গৃহিণী ও ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য খুব ভালো।
ছাগল কেনার সময় যে সব দিক লক্ষ রাখতে হবে
ছাগল পালনের জন্য কেনার সময় কিছু বিষয় ভালোভাবে লক্ষ্য না রাখলে পরে রোগ, ক্ষতি
বা লোকসানের মুখে পড়তে হয়। তাই সচেতনভাবে নির্বাচন করা খুব জরুরী। যেমন-ছাগল
কেনার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ছাগলের চোখ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার হয়। নাক যেন
শুকনো থাকে নাক দিয়ে পানি পড়া ঠিক নয়। এছাড়াও শরীর মোটা তাজা কিন্তু অতিরিক্ত
মেদ কম, লোম মসৃণ ও উজ্জ্বল হবে, খাড়া খাড়া নয়। চোখ স্বাভাবিক ও উজ্জ্বল হবে।
যদি দুধের জন্য ছাগল কেনা হয়় তবে বাচ্চা দেওয়ার পর কতটুকু দুধ দেয় তা দেখে
নিন।
শরীরের লোম মসৃণ ও চকচকে হবে। দাঁড়াতে ও হাঁটতে স্বাভাবিক হবে। তাছাড়া ছাগল
কেনার সময় চোখ -নাক- মুখ পরিষ্কার ,লোম উজ্জ্বল দাঁত দেখে বয়স যা চাই, জাত
প্রজনন ক্ষমতা নিশ্চিতকরণ, রোগ মুক্ত টিকা দেওয়া আছে কিনা এসব বিষয়ে সক্রিয়
থেকে ছাগল কিনতে হবে। সংক্ষেপে বলা যায় সুস্থ, মোটা-তাজা, টিকা দেওয়া এবং বয়স
উপযোগী ছাগল কিনতে হবে।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের দাম:
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের দাম অনেক ভিন্ন হতে পারে_বয়স, ওজন, লিঙ্গ, স্বাস্থ্য,
ছেলেটি ক কোয়ালিটি, বাজার স্থান ইত্যাদি উপর ভিত্তি করে ছাগলের দাম নির্ধারিত
হয়ে থাকে। যেমন-সাধারণত একটি বাচ্চা ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের দাম ৩০০০ -
৬০০০ হাজার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
আর বড় ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের দাম ৭০০০-১৫০০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে বা তার থেকে
বেশিও হতে পারে। এছাড়াও বাসা বাড়িতে পালন ও খামারের পালনের ক্ষেত্রে দাম
কিছুটা কম বেশি হয়ে থাকে। আর এই ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন খুব লাভজনক হয়ে
থাকে।
ছাগলের দাঁত দেখে বয়স নির্ণয়
ছাগলের বয়স নির্ণয়ের সবচেয়ে প্রচলিত উপায় হল দাঁত দেখা। দাঁত দেখে সহজেই
আন্দাজ করা যায় ছাগল কত বছরের। ছাগলের দাঁত দেখে বয়স নির্ণয় করা সহজ কৌশল।
যেমন-
১ বছর=২ দাঁত
২ বছর=৪ দাঁত
৩ বছর=৬ দাঁত
৪ বছর=৮ দাঁত হয়ে থাকে। আর এই দাঁত দেখেই ছাগলের বয়স যাচাই বা নির্ণয় করা হয়ে
থাকে। এক বছর বয়সে ছাগলের সামনের দুটি স্থায়ী দাঁত গজায়, দুই বছর বয়সে মোট
চারটি দাঁত হয়, তিন বছর বয়সে ৬ টি স্থায়ী দাঁত হয়, শুধু একপাশে ছোট দুধ দাঁত
দেখা যায়। চার বছর বয়সে সব মিলিয়ে আটটি স্থায়ী দাঁত হয়। অর্থাৎ সামনে সব
দাঁত শক্ত ও বড় হয়ে যায়। পাঁচ বছর বা তার বেশি হলে দাঁতগুলো ঘষা খেয়ে
ভাঙাচোরা বা ছোট হতে শুরু করে, বয়স্ক ছাগলের দাঁত ফাঁকা লেখা যায় এবং দাঁত ঢিলা
হয়ে পড়ে।
ছাগলকে পাল দেওয়ার নিয়ম ও সময়
ছাগলকে পাল দেওয়ার সঠিক নিয়ম ও সময় জানলে সুস্থ বাচ্চা, ভালো প্রজনন এবং বেশি
লাভ পাওয়া যায় ছাগল পাল দেওয়ার নিয়ম-সাধারণত ছাগী গরম হওয়ার ১২ থেকে
৩৬ ঘন্টার মধ্যে পাল দিতে হয়।
সকালে গরম হলে বিকালের মধ্যেই পাল দিতে হবে। বিকালে গরম হলে পরদিন সকালের মধ্যে
পাল দিতে হবে। সম্ভব হলে ১২ ঘন্টা ও ৩৬ ঘন্টা সময়ের মধ্যে দুইবার পাল দিতে হবে।
গাল দেওয়ার পাঁচ মাসের মধ্যে ছাগী সাধারণত বাচ্চা দেয়।
ছাগলের বাচ্চাকে খাসি করন
ছাগলের বাচ্চাকে খাসি করুন মানে হলো পুরুষ ছাগলের অন্ডকোষ অপসারণ বা অকার্যকর
করা। এটা করা হয় যেন তারা প্রজনন করতে না পারে এবং মাংস নরম ও সুস্বাদু হয়।
খাসি করণ গ্রামীণভাবে খুবই প্রচলিত কাজ। সাধারণত বাচ্চা ২ থেকে ৮ সপ্তাহ
বয়সে খাসি করালে সুবিধা হয় — তবে পদ্ধতি অনুযায়ী সময় ভিন্ন হতে পারে। বড়, ভারী বা
অসুস্থ বাচ্চা হলে স্থগিত করুন এবং প্রথমে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
এছাড়াও খাস করণের সুবিধা গুলো যেমন-। আচরণ নিয়ন্ত্রণ, মাংসের মান ও গন্ধ
নিয়ন্ত্রণ, পালনে সহায়তা জনসংখ্যা ও প্রজনন নিয়ন্ত্রণ। করুন সাধারণত ১৫ দিন
থেকে তিন মাস বয়সের মধ্যেই করা সবচেয়ে নিরাপদ। খাসি করণের পর ছাগলকে পরিষ্কার
জায়গায় রাখতে হবে যাতে ইনফেকশন না হয়। তাছাড়াও দু তিন দিন ছাগলের হাঁটাচলা
সীমিত রাখতে হবে এবং ভিটামিন ও খনিজ জাতীয় খাবার দিতে হবে।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বাসস্থান
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলকে সুস্থ ও ভালোভাবে বড় করতে হলে সঠিক বাসস্থান খুব জরুরী।
কারণ পরিষ্কার, শুকনা আর আরামদায়ক ঘর থাকলে ছাগল কম রোগে ভোগে, দ্রুত বাড়ে এবং
বাচ্চা দেওয়ায় হার ও ভালো হয়।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বাসস্থান সাধারণত উঁচু ও শুকনো জায়গায় ঘর রাখা উচিত। ঘরে
যেন পর্যাপ্ত বাতাস ঢুকতে পারে এমন ভাবে ঘরটা তৈরি করতে হবে। ঘরের ভেতরের পানির
পাত্র ও খাবারের খাঁচা আলাদা রাখতে হবে। খাবার এমনভাবে দিতে হবে যেন মাটিতে না
পারে
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের খাদ্য খাবার
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল ছোট আকারের হলেও খাবারে খুব বেছে চলে না। তবে সঠিক ও সুষম
খাবার দিলে এরা দ্রুত বাড়ে, বেশি দুধ ও মাংস দেয়, আর সুস্থ থাকে। ব্ল্যাক
বেঙ্গল ছাগলের সবচেয়ে ভালো খাবার হলো সবুজ ঘাস, কলা গাছের কান্ড, কচি বাঁশপাতা,
গাছের পাতা ইত্যাদি খেয়ে থাকে। এছাড়া ছাগলের প্রাকৃতিক খাবার যেমন -নেপিয়ার
ঘাস, কলমি শাক, কলা পাতা ও কান্ড, লতা পাতা ইত্যাদি।
তাছাড়াও শুকনো খড়, ভুসি, শুকনো খরকুটো, গোল মিষ্টি ও কনসেনট্রেশন, খনিজ ও
পরিষ্কার পানি জাতীয় খাবার ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জন্য খুব ভালো। এছাড়া ছাগলের
বাচ্চার ক্ষেত্রে বাচ্চা জন্মের পর 30 মিনিটের মধ্যে মা ছাগলের দুধ খাওয়াতে হবে।
দুই সপ্তাহ বয়স থেকে সামান্য ঘাস ও ভুসি খাওয়ানোর শুরু করতে হবে। তিন মাস বয়সে
ধীরে ধীরে প্রাপ্ত বয়স্কদের খাবার দেওয়া শুরু করতে হবে। আর কিছু সতর্কতা যেমন
পচা ও ছত্রাকযুক্ত খাবার দেওয়া যাবে না। সব সময় তাজা ঘাস কেটে দিতে হবে। নতুন
খাবার অল্প অল্প করে খাওয়াতে হবে একবারে বেশি পরিবর্তন করলে হজমের সমস্যা হতে
পারে।
ছাগলের রোগ ও তার প্রতিকার
ছাগল খুব উপকারী প্রাণী হলেও অনেক সময় নানা রোগে আক্রান্ত হয়। সময় মত প্রতিরোধ
এবং চিকিৎসা না করলে বড় ক্ষতি সম্ভাবনা থাকে। সাধারণত ছাগলের রোগ গুলো
যেমন- জ্বর, নাক মুখ দিয়ে পানি পড়া, শ্বাসকষ্ট, পাতলা ডায়রিয়া, মুখে ঘা
ইত্যাদি।
এগুলো রোগ সাধারণত ভাইরাস জনিত কারণে হয়ে থাকে। তাই বছরে একবার পিপিআর ভ্যাকসিন
দিতে হবে। প্রতি তিন থেকে চার মাস পর কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে। এছাড়াও
পরিষ্কার ও শুকনো জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন ছাগল আনলে অন্তত ১৫ দিন
আদা রেখে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নিয়মিত টিকা দিতে হবে, এবং তিন মাস অন্তর
কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে। পুরস্কার পানীয় পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করতে হবে,
অসুস্থ ছাগলকে আলাদা রাখতে হবে।
শেষ কথা:
ছাগল রোগে মারা গেলে অবশ্যই মাটির নিচে পুঁতে রাখতে হবে। অযত্নে ফেলে দিলে সেই
রোগ অন্য প্রাণীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।